সমর ইসলাম
যুদ্ধ সবাই করে না, করতে পারে না, করতে হয় না, প্রয়োজনও নেই। সরাসরি যুদ্ধ করা একজন সাধারণ সৈনিক ঘরে বসে থাকা সর্বাধিনায়কের চেয়ে উত্তম। প্রত্যেক যুদ্ধেই সিরাজ-উজ-দৌলা থাকে, মীর জাফর, মীর মদন, মোহন লালও থাকে। থাকে ঘসেটি বেগমও। বলা হচ্ছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে পৃথিবীর মানুষ। এবং এ এক কঠিন যুদ্ধ। সচেতনতা, মানবিকতা, মূল্যবোধ আর মানুষ পরিচয় দেয়ার মোক্ষম সময়। তবে যুদ্ধ সবাই না করলেও ফল ভোগ করে সবাই। কেউ শহীদ হয়, পঙ্গু হয় আবার কেউ পায় খেতাব। কেউ ক্ষমতা পায়, কেউ হারায় আবার কেউ পায় ভাতা। কিন্তু যারা যুদ্ধ করে, সত্যিকার সৈনিক তারা কখনও কোনো কিছুর প্রত্যাশায় যুদ্ধ করে না।
আজকের দিনে নিজেকে বড় বেশি ক্ষুদ্র মনে হচ্ছে। এতবড় মানবিক বিপর্যয়ে আমি তেমন কোনো কাজে আসছি না। মানুষকে সচেতন করতে রাস্তায় নামছি না, সামর্থ্য নেই বলে ত্রাণ দিতে পারছি না; নিদেনপক্ষে এসব কর্মকাণ্ডের একজন পরিশ্রমী স্বেচ্ছাসেবকও হতে পারছি না। অনেকে ফেসবুকে নানা রকম প্রচারণা চালিয়ে দায়িত্ব পালন করছেন। জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার জন্য আমি সেটাও পারছি না। তবে একেবারে দর্শক হয়ে চুপ করে বসেও নেই আমি। শুধু চাকরিটা করছি। যতটা না জীবিকার প্রয়োজনে তারচেয়ে বেশি ওই যে ‘কোনো কিছু করতে না পারা’র দায়বোধ থেকে।
ঘরবন্দী ছোট দুটি ছেলে আর স্ত্রীর শুকনো মুখটা দেখে অফিসের উদ্দেশে বের হই। আবার ফিরি রাতে। ছেলেরা জেগে থাকে। বাবা আসবে। অত্যন্ত আগ্রহে ছুটে আসে বাবাকে জড়িয়ে ধরবে বলে। কিন্তু কঠোর বাধার মুখে পড়ে তারা। বড়টা মুখ গোমরা করে সরে দাঁড়ায়। চোখ টলটল করে জলে। ছোটটা মানতে নারাজ। দৌড়ে এসে ঝাপটে ধরতে চায়। তার মা জোর করে আটকে রাখলে চিৎকার দিয়ে মেঝেতে গড়াগড়ি। বাবাকে তাদের অচেনা লাগে। মানতে চায় না নিষেধের এই বেড়া। তাদের চোখে আমি লকডাউন মানাতে পেটোয়া বাহিনীর সদস্য হতে পারি না। খুব খারাপ লাগে, খু-উ-ব।
বিজ্ঞানী নিউটনও বলেছেন, প্রত্যেক ক্রিয়ার একটা প্রতিক্রিয়া আছে। আর ধর্মে তো ভালো কাজের বিরাট প্রতিদানের কথা বলাই আছে। সেই আশায় কাজ করে যাচ্ছি। অতি সামান্য সংবাদকর্মী আমি। সারাদেশের পরিশ্রমী সংবাদকর্মীদের আহরিত সংবাদ ছেনে দর্শক-শ্রোতার প্রয়োজন মতো তা উপস্থাপন করছি। এতে কেউ শঙ্কিত হচ্ছেন; কেউ বিব্রত হচ্ছেন আবার কেউ সচেতনও হচ্ছেন। কোনো না কোনোভাবে এসব সংবাদ যদি মানুষের উপকারে আসে তাতেই করোনাকালে নিজের শ্রমকে সার্থক মনে করবো। অন্তত ঘরে থাকা সৈনিকের চেয়ে আমি তো একটু হলেও এগিয়ে। আর কাজের স্বীকৃতি কিংবা বদলা কোনো মানুষের কাছে চাই না। কারণ, সকল চিন্তার মানুষই আজ ভালো করে বুঝতে পারছে পৃথিবীতে তারচেয়ে বেশি মুখাপেক্ষি আর কেউ নেই। সুতরাং কোনো মুখাপেক্ষির মুখাপেক্ষি হওয়ার আগ্রহ আমার নেই। আমি তাঁরই মুখাপেক্ষি, সমগ্র জগত যাঁর মুখাপেক্ষি। তিনিই উত্তম দাতা এবং দয়ালু।
প্রার্থনা: হে প্রভু! তোমার সৃষ্টি-বাগান তোমার ইচ্ছেমতো সাজিয়ে নাও! শুধু ভালোবেসে সৃষ্টি করা অবাধ্য মানবজাতিকে তুমি আর লাঞ্ছিত করো না- দুনিয়া কিংবা আখেরাতে। সীমিত জ্ঞানে তোমায় বুঝতে পারুক আর না পারুক, সে তো আত্মসমর্পিতই; তোমারই দিকে।