নিজস্ব প্রতিবেদক, করোনা ভাইরাস বিস্তার রোধে সরকার গণজমায়েত নিষিদ্ধ করেছেন। এর আগে বগুড়া জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে বগুড়ার শাজাহানপুরে মাছের আড়তে গণজমায়েত বন্ধ হয়নি। আড়তে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চলে মাছ বিক্রি। এখানে কেউ এসেছেন মাছ বিক্রি করতে। আবার কেউ এসছেন কিনতে। এখানে সবর রয়েছেন ব্যবসায়ী আর আড়তদারেরা। উপজেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে তারা এখানে এসে গণজমায়েত সৃষ্টি করছেন। দূরত্ব তো নয়ই, শতশত মানুষের মধ্যে কারও মুখে মাস্ক পর্যন্ত দেখা যায়নি।
গতকাল সোমবার দুপুর ১টার দিকে এমন দৃশ্য দেখা মেলে শাজাহানপুর উপজেলার ঢাকা-বগুড়া মহাসড়ক সংলগ্ন মাঝিড়া পাইকারি মাছের আড়তে। করোনা সচেতনতায় মাস্ক পড়া তো দূরের কথা, সবাই গাঁ ঘেঁষাঘেঁঘি করে মাতিয়ে রেখেছেন এই আড়ত। তাদের মধ্যে অনেকেই সরকারের দেওয়া নির্দেশনাকে ‘নিছক’ বক্তব্য মনে করছেন। শাজাহানপুর উপজেলা থেকে এই মাছের আড়তের দূরত্ব দেড়শ মিটার হবে। অথচ উপজেলা প্রশাসনের দাবি, তারা শাজাহানপুর উপজেলার সবচেয়ে বড় এই আড়ত সম্পর্কে তারা কিছুই জানেন না।
সারা দেশের মতো করোনা প্রতিরোধে গতকাল সেমাবার সকালে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কার্যালয় থেকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ফয়েজ আহাম্মদ স্বাক্ষরিত এক গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে গণজমায়েত অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়। গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, জেলায় মেলা, যাত্রা, গানের আসর, কমিউনিটি সেন্টারে বহু লোকের উপস্থিতিতে বৈবাহিক অনুষ্ঠান, চা স্টল বা দোকান, হোটেল-রেস্তোরাঁয় আড্ডা, পিকনিক স্পট, বিনোদন পার্ক, কোচিং সেন্টার, ক্লাবসমূহ গণজমায়েত, ক্লাব ভিত্তিক টুর্নামেন্ট, ধর্মীয় অনুষ্ঠান যেমন- ওয়াজ-মাহফিল, নামযজ্ঞ, কীর্তনসহ সকল প্রকার গণজমায়েত পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে।
এর আগেও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে করোনা ভাইরাস বিস্তার প্রতিরোধে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। তবে তবে শাজাহানপুর উপজেলা মাঝিড়া এলাকায় ওই মাছের আড়তে এই নির্দেশানার ছিটেফোটাও কাউকে পালন করতে দেখা যায়নি। নির্দেশনা কর্নপাতও করছেন না মাঝিড়া বন্দরের মাছের আড়তদারেরা।
সরেজমিনে দেখা যায়, স্থানীয়সহ বিভিন্ন জেলা এবং উপজেলা থেকে মাছ ব্যবসায়ীরা এই আড়ত থেকে পাইকারি মাছ কিনতে এসেছেন। আবার কেউনিজের পুকুরের মাছ বিক্রি করতে এসছেন। সকাল ১১ টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত শতশত মানুষের জনসমাগম চলে এই মাছের বাজারটিতে। আর এখানে আড়তদারদের মাধ্যমে পাইকারি মাছ বিক্রি করা হয়ে থাকে। এ কারণেই এই মাছের আড়তে শতশত মাছ ব্যবসায়ীর ভীর লেগে থাকে প্রতিদিন।
এই মাছের পাইকারি বাজারে সতর্কতামূলকভাবেও কারও মুখে মাস্ক নেই। শহরের গন্ডগ্রাম থেকে এই আড়তে মাছ কিনতে আসা মাছ ব্যসাসায়ী আব্দুর রহিমের সাথে কথা হয়। তিনি জানান, এখানে সকাল থেকেই মাছ আনতে শুরু করেন চাষীরা। শতশত মাছ ব্যবসায়ী এখান থেকে পাইকারি দরে মাছ কিনতে আসেন। এখান থেকে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ কিনে ব্যবসায়ীরা বনানীসহ উপজেলার বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করেন। এভাবে দিনের পর দিন চলছিল। কিন্তু হঠাৎ করে করোনা ভাইরাসের কারণে সতর্কতা চালু হয়েছে, টিভিতে দেখানো হচ্ছে। কিন্তু কজন মানে। আর বাংলাদেশে মাঠ পর্যায়ে আইনের প্রয়োগ হলেই কেবল জনগণ সচেতন হবে। এই কারণেই মাছের এমন বড় আড়তেও কেউ সচেতন হয়নি।
সরকার অনির্দিষ্টকালের জন্য গণজমায়েত নিষিদ্ধ করেছে, বিষয়টি জানা আছে কিনা, জানতে চাইলে আব্দুর রহিম আরও বলেন, ‘কেউ তো এ কথা বলেনি। এখনই জানতে পারলাম। আর করোনার কথা ভাবলেই তো হবেনা। আমাদের তো পেট চলতে হবে। এই বাজারে না আসলে আমাদের সংসার চলবে কীভাবে।’
মাঝিড়া বন্দরের বাবলু নামের আরেক মাছ ব্যবসায়ি বলেন, করোনা ভাইরাসে যেন অক্রান্ত না হই। এটা আমরাও তো চাই। কিন্তু আমরা মাছ বিক্রি করতে না পাড়লে দৈনিক রোজগার বন্ধ হয়ে যাবে। এই আড়তের সাথে শত শত ব্যবসায়ীর জীবিকা চলে।’
উপজেলার সাবরুল এলাকা মাছ চাষি নজরুল ইসলাম। তিনি মাঝিড়া মাছের আড়তে তার নিজের পুকুরের পাঙ্গাস এবং রুই মাছ বিক্রি করতে এসেছেন। তিনি বলেন, মাছ পালনের একটা সময়সীমা রয়েছে। যদি ওই সময়ের মধ্যে বাজারে মাছ বিক্রি করতে না পারি তাহলে নিশ্চিত লোকসান গুণতে হবে। তাই বাধ্য হয়ে মাছের আড়তের এ গণজমায়েত এসেছি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু মাঝিড়াতেই নয়, উপজেলার আড়িয়া বাজারে প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে মাছের পাইকারি বাজার বসে। এখানে ব্যবসায়ীদের মধ্যে করোনা নিয়ে কোনো সতর্কতা নেই। এই বাজরের আড়তদার বলরামের সাথে কথা হয়। তিনি জানান, এখানে পাইকারি মাছ বিক্রি হয়। মাছ কিনতে জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে শতশত মাছের পাইকার এই বাজরে আসে। এলাকায় কেউ আক্রান্ত হয়নি বলে করোনা নিয়ে কারও মধ্যে তেমন উৎকণ্ঠাও নেই।
এ বিষয়ে মাছের আড়তের ব্যবসায়ীদের সংগঠন মাঝিড়া বহুমুখী মৎস সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুনছুর আলী বলেন, কয়েকদিন আগে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দেখা করেছেন। তিনি বিদেশ ফেরৎ মানুষদের তাৎক্ষণিক তথ্য চেয়েছেন। কিন্তু মাছের আড়ত বন্ধের বিষয়য়ে এখনও কিছু বলেন নি। যদি উপজেলা প্রশাসন থেকে বন্ধ করার নির্দেশ দেন তাহলে পাইকারি বাজারটি বন্ধ করে দেয়া হবে।
শাজাহানপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মাহ্মুদা পারভীন জানান, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।’
অথচ তার কার্যালয় থেকে শাজাহানপুরের মাঝিড়া এলাকার ওই মাছের আড়তের দূরত্ব ১৫০ মিটার হবে। প্রতিদিনই এই আড়তে শতশত মানুষের মজায়েত হয়।
এ ছাড়ার বিস্তার রোধে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে মঙ্গলবার থেকে মাঠে থাকছেন সেনাবাহিনী। বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতে সামাজিক দূরত্ব এবং সতর্কতামূলক ব্যবস্তার জন্য বেসরকারি প্রশাসনকে সহায়তা দিতে সেনাবাহিনী নিয়োজিত হচ্ছে। সোমবার বিকেলে সচিবালয়ে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানান মন্ত্রীপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম।